Wikipedia

Search results

Tuesday, 23 April 2019

দেশ ভাগ, ভারত – পাকিস্থান সংঘাত ও কাশ্মীর প্রসঙ্গ


   





   পুলওয়ামা হামলার পর জণসাধারণের মধ্যে সর্বাধিক চর্চিত বিষয় ছিল দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত পাকিস্থান কি একে পরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে? সময় জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উগ্র জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করে কাশ্মিরী জনগনের উপর বিদ্বেষমূলক ব্যবহার শুরু করে অপরপক্ষে কিছু মানুষ এই উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করে সাধারণ কাশ্মিরী জনগনের প্রতি সমবেদনা জানান। কে ঠিক বা কে ভুল সে আলোচনায় না গিয়ে একটি কথা বলা যায় যে, অধিকাংশ ব্যক্তিই কাশ্মীরের ইতিহাস কাশ্মীর সমস্যার প্রকৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহল নয়। পাঁচ হাজার বছরেরও বেশী পুরানো ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তনের ফলাফল আজকের ভারতীয় উপমহাদেশ তার ভৌগলিক বন্টন। ঐতিহাসিকভাবে  এটি সত্য যে ভারতীয় উপমহাদেশে যে রাষ্ট্রগুলি আছে তাদের অধিকাংশ একদা ছিল ভারতের রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক অংশ। ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার বিভাজন নীতির চূড়ান্ত ফল   দেশ বিভাজনের মাধ্যমে  ভারতীয় উপদ্বীপের স্বাধীনতা। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি  যখন ভারত স্বাধীনতা পেল, বৃহত্তর শক্তি হিসাবে তার উত্থান প্রতিবেশী পাকিস্থানের উষ্মার কারণ হয় পাক রাষ্ট্র নেতারা মনে করেন যে  পাকিস্থানের স্বাধীন আস্তিত্বকে ভারত কখনই স্বীকার করবে না এবং বৃ্হৎ রাষ্ট্র হিসাবে সে পাকিস্থানকে এক সময় গ্রাস করবে।  স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই দুই রাষ্ট্র একে অপরের শত্রুতে পরিণত য়।যা অন্যতম কারণ কাশ্মীরের উপর উভয়েরই  দাবী।বর্তমান কাশ্মীর সমস্যার স্বরূপ বুঝতে গেলে ভারত-পাকিস্থানের স্বাধীনতা দেশ বিভাজনের প্রেক্ষাপটে কাশ্মীরের ইতিহাস জানা  আবশ্যক।
    কাশ্মীরের ইতিহাস বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের  ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীরকে 'কাশ্মীর উপত্যকা' নামে অভিহিত করা হয়েছে তবে রাজনৈতিকভাবে কাশ্মীর বলতে অপেক্ষাকৃত একটি  বৃহৎ অঞ্চলকে বোঝায় যা ভারতীয় জম্মু-কাশ্মীর  রাজ্য;  পাকিস্থান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর,গিলগিট-বাল্টিস্থান  এবং চিন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চিন, ট্রান্স কারাকোরামকে অন্তর্ভুক্ত করে। বর্তমানে অশান্ত এই ভূখন্ডের প্রথম ইতিহাস জানা যায় কলহন রচিত রাজতরঙ্গিনী থেকে।কলহনকে কাশ্মীরের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক হিসাবে গন্য করা হয়।পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ববর্তী সময়ে কাশ্মীর প্রথমে হিন্দুধর্ম এবং পরে বৌদ্ধধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরবর্তীতে নবম শতাব্দীতে কাশ্মীরে শৈব মতবাদের উত্থান ঘটে ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরে ইসলামধর্মের বিস্তার ঘটে এবং শৈব মতবাদের প্রভাব হ্রাস পায়। কিন্তু তাতে পূর্ববর্তী সভ্যতাগুলোর নিদর্শন গুলি হারিয়ে যায়নি, বরং নবাগত ইসলামি রাজনীতি সংস্কৃতি এগুলোকে বহুলাংশে অঙ্গীভূত করে নেয়, যার ফলে জন্ম হয় কাশ্মিরী সুফিবাদের
    ১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হন এবং শাহ মীর রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীব্যাপী কাশ্মীরে মুসলিম শাসন বজায় ছিল। ৫৮৬ তে মুঘল সম্রাট আকবর কাশ্মীর দখল করেন ৫৮৬ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর মুঘল সম্রাজ্যের অধীন ছিল। এরপর আফগান দুররানী সম্রাটরা ১৮১৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করেন। ১৮১৯ সালে রঞ্জিত সিংহের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে। রঞ্জিত সিং ১৮২০ সালে  ডোগরা নৃ্পতি গুলাব সিং-কে জম্মুর শাসনকর্তা হিসাবে নিযুক্ত করেন। ১৮২২ সালে গুলাব সিং রাজা উপাধি লা্ভ করেন।১৮৩৯ সালে সালে রঞ্জিত সিংহের মৃত্যুর পর গুলাব সিং-এর প্রভাব বৃদ্ধি পায়।প্রথম ঈঙ্গ-আফগান যুদ্ধে (১৮৪১ সালে ) যখন শিখরা সৈন্য চলাচলের জন্য পথ খুলতে অস্বীকার করে তখন গুলাব সিং জম্মুর সড়ক খুলে দিয়ে ব্রিটিশদের সা্হায্য করেন।এরপর ১৮৪৬ সালে প্রথম ঈঙ্গ- শিখ যুদ্ধ যা সোবরায়োঁর লড়াই নামে পরিচিত, গুলাব সিং শিখদের হয়ে যুদ্ধ না করে সরে দাঁড়ান ফলে শিখরা অল্পের জন্য পরাজিত হয়।এর স্বীকৃতিস্বরূপ অমৃতসর চুক্তি অনুসারে গুলাব সিং ৭৫ লক্ষ টাকায়  ব্রিটিশদের কাছ থেকে কাশ্মীর ক্রয় করেন, যা নানকসাহী নামে পরিচিত অমৃতসর চুক্তি দশম অনুচ্ছেদে বলাছিল, গুলাব সিং ব্রিটিশদের আনুগত্য স্বীকার করবেন এবং এর স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতি বছর তিনি ব্রিটিশ সরকারকে নজরানা দেবেন একটি ঘোড়া, বারোটি ছাগল এবং তিন জোড়া কাশ্মীরী শাল। ব্রিটিশদের কাছ থেকে জম্মু কাশ্মীর দান হিসাবে গ্রহন করে গুলাব সিং নিজেকেজার খরিদবা স্বর্ণে-ক্রীত দাস বলে ঘোষনা করেন।এভাবে ব্রিটিশরা কূটনৈতিক চালে কাশ্মীরের মত গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক খন্ডে একজন বিশ্বস্ত প্রতিনিধি পেয়েছিল। এমনকি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় গুলাব সিং তাঁর পুত্র রনবীর সিং কে ২০০০ পদাতিক. ২০০ আশ্বারোহী সেনা টি কামান দিয়ে দিল্লী দখলে সাহায্য করেন। ১৮৫৮ সালে গুলাব সিং প্রয়া হবার পর- তাঁর উত্তারাধিকারীদের মধ্যে ব্রিটিশ আনুগত্যের ভাঁটা পরেনি।প্রথম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাশ্মীরের শাসকরা ব্রিটিশদের পক্ষে বাহীনি পাঠায় ১৯৪৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত একশো বছর ধরে গুলাব সিং-এর বংশধরগণ ব্রিটিশ রাজমুকুটের অনুগত শাসক হিসেবে কাশ্মীর শাসন করেন।কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগর শীতকালীন রাজধানী জম্মু শহরের মধ্যে সড়ক নির্মানের মাধ্যমে ডোগরারা অবশিষ্ট ভারতের সাথে কাশ্মীরের যোগাযোগ স্থাপন করে ডোগরা শাসনকালে উত্তর কাশ্মীর কাশ্মীর উপত্যকার ৯০ শতাংশ অধিবাসী ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত এবং বাকি ১০ শতাংশে অধিকাংশই ছিলেন কাশ্মীরি পন্ডিত উভ সম্প্রদায়ের মানুষেরা সৌহার্দ্য ভ্রাতিত্বপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করতেন। অন্যদিকে জম্মু ছিল মূলত হিন্দু ডোগরাদের বাসভূমি। লাদাক সহ উত্তর-পূর্ব কাশ্মীরে ছিল তিব্বতী সংস্কৃতির প্রাধান্য অধিবাসীরা ছিলেন মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী
   ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ ৯০% মুসলিম সংরক্ষিত আসনে জয় লা্ভ করলে ব্রিটিশ সরকার মুসলিম লীগকে ভারতীয় মুসলিমদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকার করে নেয়।  উক্ত পরিস্থিতিতে ১৯৪৭ সালের জুন মাসে মুসলিম লীগের দাবি আনুসারে ব্রিটিশরা পাকিস্থান প্রস্তাবকে মান্যতা দেন এবং স্থির হয় মুসলিম অধ্যুষিত বালুচিস্থান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধ প্রদেশ, পশ্চিম পাঙ্জাব পূর্ববঙ্গ নিয়ে গঠিত হবে পাকিস্থান।  Indian Independence Act (1947 c. 30 (10 & 11. Geo. 6.) বলা হয় দেশীয় রাজণ্য শাসিত রাজ্যগুলি নিজেদের জনবিন্যাস, ভৌগলিক আবস্থান (নৈকট্য) অনুসারে স্থির করবে তারা ভারত না পাকিস্থানে অর্ন্তভুক্ত হবে। হায়দ্রাবাদ, জুনাগড়, ভোপাল, যোধপুর, ত্রিবাঙ্কুর ছাড়া বাকি রাজণ্য শাসিত রাজ্যগুলি যারা ভৌগলিকভাবে ভারতীয় ইউনিয়নের কাছাকাছি ছিল, ভারতভুক্তিতে রাজি হয়। হায়দ্রাবাদ, জুনাগড়, ভোপালের প্রশাসকরা ছিল মুসলমান কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজারা ছিলেন হিন্দু। কিন্তু যোধপুর, ত্রিবাঙ্কুর ছিল সম্পূর্ন হিন্দু রাষ্ট্র। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসের মধ্য বিভিন্ন ঘটনা পরন্পরায় বিশেষত: সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, ভি.কে কৃষ্ণমেননর দূরদর্শীতার জন্য যোধপুর, ত্রিবাঙ্কুর,ভোপাল বলপ্রয়োগ ছাড়াই ভারতীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হতে রাজি হয় হায়দ্রাবাদের নিজাম মীর উসমান আলি ভারত বা পাকিস্থানে না গিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ব্রিটিশ কমনওয়েলথ সদস্য হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন১৯৪৮ সালে লর্ড মাউন্টব্যাটেন পদত্যাগ করলে ১৩ই সেপ্টেম্বর বল্লভ ভাই প্যাটেল সেনা অভিযানের দ্বারা (‘অপারেশন পোলো’) চার দিনের মধ্যে হায়দ্রাবাদের দখল নেন।
   এই আলোচনায় আমরা জুনাগড়ের ভারত অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বিশদে আলোচনা করব কারন ১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের পরিস্থিতির সাথে জুনাগড়ের সাদৃশ্য ছিল গুজরাটের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত জুনাগড়ের  পরিস্থিতি ছিল বাকি চারটি রাজণ্য শাসিত রাজ্যগুলি থেকে আলাদা ১৯৪৭ সালের ২৫শে জুলাই লর্ড মাউন্টব্যাটেন জুনাগড়ের রাজপরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণে জুনাগড়কে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। কারন জুনাগড়ের সাথে প্রস্থাবিত পাকিস্থানের কোন স্থল সংযোগ ছিল না। প্রসঙ্গত: বলা যায় যে, নবাবের আইনি উপদেষ্ঠা নায়েব নবি বক্সও একই মত ব্যক্ত করেন। কিন্ত মুসলিম লীগের নেতারা জুনাগড়কে পাকিস্থানে অন্তভুক্ত করার জন্য এই যুক্তি দেন যে, সমুদ্রপথে জুনাগড় পাকিস্থানের সাথে সহজেই যোগাযোগ রাখতে পারবে।১৯৪৭- প্রথম দিকে যে নবি বক্স মুসলিম লীগের নেতা স্যার শাহ নওয়াজ ভুট্টোকে জুনাগড়ের মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান, সেই ভুট্টোই নবি বক্সের আনুপস্থিতিতে জুনাগড়ের নবাবকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে চাপ দেন।ফলে পাকিস্থানের সাথে কোন সাধারণ সীমানা সংযোগ না থাকলেও ১৯৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর, জুনাগড়ের নবাব তৃতীয় মহম্মদ মহাবত খানজি পাকিস্থানের সাথে যুক্ত হওয়ার সম্মতি দেন ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৭, পাকিস্থান সরকার তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করেন এর ফলে জুনাগড়ের প্রজারা প্রবল অসন্তোষ প্রকাশ করে আন্দোলন শুরু করে।জুনাগড়ের আধীন দুই ছোট রাজ্য মঙ্গল বাবরিয়াওয়াদের শাসকরা জুনাগড় থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। প্রত্যুত্তরে নবাবের সেনা দুটি রাজ্যে দখল করে নেয়।অন্যান্য প্রতিবেশী দেশীয় রাজ্যের শাসকেরা জুনাগড় সীমান্তে সেনা পাঠানো শুরু করে এবং সাহায্যের জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানায়।ভারতীয় নেতৃবর্গ মনে করেন জুনাগড় পাকিস্থানের সাথে যুক্ত হলে গুজরাটের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধিপাবে কারণ জুনাগড়ের ৯৬% অধিবাসী ছিলেন হিন্দু। সুতরাং, নবাবের পাকিস্থানে যুক্ত হবার প্রস্তাব তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেন।ভারত জুনাগড়ে জ্বালানী তেল, কয়লা সরবরাহ, ডাক-তার পরিষেবা বন্ধ করে সেনা পাঠিয়ে মঙ্গল বাবরিয়াওয়াদ দখল করেএই পরিস্থিতিতে পাকিস্থান ভারতকে সেনা প্রত্যাহারের বিনিময়ে গণভোটের প্রস্তাব দেয় কিন্তু ভারত তা অস্বীকার করে। ২৬শে অক্টোবর, নবাব তার পরিবার ভারতীয় সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষের পর পাকিস্তানে পালিয়ে যায়।৭ই নভেম্বর জুনাগড়ের সেনাবাহীনি পরাজয় স্বীকার করে।জুনাগড়ের দেওয়ান জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিতা স্যার শাহ নওয়াজ ভুট্টো,ভারত সরকারকে হস্তক্ষেপ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে সৌরাষ্ট্রের আঞ্চলিক কমিশনার মিস্টার বুচকে চিঠি দেন।পাকিস্থান ভারতের সেনা আভিযানের প্রতিবাদ করলে ভারত সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে এবং দেওয়ানের আমন্ত্রণ গ্রহণের মাধ্যমে জুনাগড়ের নিয়ন্ত্রন লা্ভ করে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত জুনাগড়ে একটি গণভোটের আয়োজন করে, তবে এটি আন্তর্জাতিক নজরদারিতে করা হয় নি। এই গণভোটের ফল স্বাভাবিকভাবে ভারতের অনুকূলে যায়।ভারত যে প্রক্রিয়ায় জুনাগড়ের নিয়ন্ত্রণ নেয় সেই যুক্তিতে পাকিস্থান পরবর্তীকালে কাশ্মীরের উপর অধিকার চেষ্টা দাবি করে।
   ভারত বিভাগের সময়  সমগ্র কাশ্মীর একটি বিবাদমান অঞ্চলে পরিণত হয় কারণ ১৯৪৭ সালে জম্মুর দক্ষিনাংশ হিন্দুগরিষ্ঠ হলেও সমগ্র রা্জ্যের নিরিখে মুসলমানেরা হিন্দুদের চেয়ে প্রায় তিনগুন বেশি ছিল। তাই দেশবিভাগের প্রক্ষাপটে মহম্মদ জিন্না স্বাভাবিক ভাবেই কাশ্মীরের দাবি করেন। জিন্না কাশ্মীরের পাকিস্থানভুক্তির জন্য প্রথমে হিন্দু রাজা পরে মুসলমান জননায়ক বিশেষত: শেখ আব্দুল্লা তার অনুগামিদের তোষামোদ করেও ব্যর্থ হন।কাশ্মীরের তৎকালীন রাজা হরি সিং তার মন্ত্রীপরিষদ পাকিস্থান বা ভারতের অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে থাকার মনস্থির করেন। তৎকালীন কাশ্মীরের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল ন্যাশনাল কনফারেন্স। শেখ আব্দুল্লা ছিলেন ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রবাদ প্রতিম নেতা যার সাথে ছিল মৌলানা আবুল কালাম আজাদ নেহেরুর সখ্যতা। এই সময় কাশ্মীরের রাজা হরি সিং উপর নানা কারনে সর্বস্তরের কাশ্মীরী জনগণ ছিলেন ক্ষুদ্ধ এবং তাঁর কোন জনভিত্তি ছিল না।ন্যাশনাল কনফারেন্স শেখ আব্দুল্লা ছিল আপামর কাশ্মীরী জনগনের প্রতিনিধি। ভারত বিভাগের চরম সঙ্কটাপন্ন সময়ে সারা উপমহাদেশ যখন ধর্মীয় হিংসায় মত্ত তখন কাশ্মীর ছিল আশ্চর্যরকমের শান্ত এমনকি ১৯৪0- সেই অশান্ত দশকে যখন কাশ্মীরের উপকন্ঠে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পাঙ্জাবে হিন্দু নিধন যজ্ঞ চলেছিল তখনও কাশ্মীরে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটিও সংঘাত ঘটেনি। কারণ কাশ্মিরি সুফিবাদ সৌহার্দ্য ভ্রাতিত্বের কথা বলে যাকে বলেকাশ্মীরীয়াত এই কাশ্মীরীয়াত- জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বকে অস্বীকার করে।
            ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের মাধ্যমে ভারত পাকিস্থান যখন স্বাধীনতা পেতে চলেছে তখন রাজা হরি সিং- বিরোধিতা করার জন্য শেখ আব্দুল্লা  কাশ্মীরের জেলে বন্দি। যখন কাশ্মীরের জনগন শেখ সাহেবের মুক্তির দাবিতে মুখর, নেহেরু কাশ্মীরে যেতে চান শেখ সাহেবের মুক্তির বিষয়ে কথা বলতে। তাঁকে নিবৃত করে মহত্মা গান্ধি বলেন তিনি নিজেই যাবেন কারন নেহেরু গেলে এই অপব্যাখা হবে যে হরি সিং কে তিনি ভারতে অন্তভুক্ত হবার জন্য চাপ দিতে যাচ্ছেন।কাশ্মীরে যাওয়ার আগে গান্ধিজী স্পষ্ট ভাবে জানালেন যে তিনি, কাশ্মীরীদের ভারতে যুক্ত হবার আবেদন নিয়ে যাচ্ছেন না, তারা ভারতে না পাকিস্থানে থাকবেন, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব কাশ্মীরীদের।কাশ্মীরে পৌঁছানোর পর গান্ধি কাশ্মীরী জনগনের উষ্ণ অর্ভথ্যনা পেলেন সমবেত জনগন তাঁর শেখ আব্দুল্লার  নামে জয়ধ্বনি দিল। কাশ্মীরের রাজা হরি সিং গান্ধিজিকে রাজ অতিথি হিসাবে আপ্যায়ন জানালে প্রথমে তিনি সাক্ষাতে অস্বীকার করেন। কিন্ত রাজার প্রধান মন্ত্রী স্বয়ং উপস্থিত হয়ে গান্ধিজিকে আনুরোধ করলে তিনি রাজার সাথে সাক্ষাত করেন এবং জানান কাশ্মীরের জনগন তাঁর (হরি সিং) উপর রুষ্ট, জনগন তাঁকে গ্রহন না করলে তিনিও তাঁর আতিথেয়তা নেবেন না।এরপর গান্ধিজি মুজাহিদ মঙ্জিলে (ন্যাশনাল কনফারেন্সের সদর দপ্তর)ন্যাশনাল কনফারেন্সের কর্মীদের উদ্দেশ্যে ভাষন দিতে গেলে প্রায় ২০,০০০এর বেশি মানুষ তাঁর জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়। সারা বিশ্ব দেখল দেশ বিভাজনের অন্তিম লগ্নে(দুই সপ্তাহ আগে)মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর কিভাবে গান্ধিজিকে আপন করে নিল।
      ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারত স্বাধীনতা পেল।কাশ্মীর Indian Independence Act (1947 c. 30 (10 & 11. Geo. 6) আনুসারে ভারত বা পাকিস্থানে যেতে পারত। ১৫ই আগষ্টের এক সপ্তাহ পর হরি সিং স্বাধীনতা ঘোষনা করলেন না আবার ভারত বা পাকিস্থানে অন্তভুক্ত হওয়ার ইঙ্গিতও দিলেন না। তিনি কাশ্মীরের স্বাধীনতা বজায় রাখার চেষ্টায়  ভারত বা পাকিস্থানের সাথে আলোচনা বিলম্বিত করছিলেন।সেই সময়ের স্বাভাবিক প্রবণতা আনুসারে দেশীয় রাজারা মূলত প্রজাদের ইচ্ছানুসারে ভারত বা পাকিস্থানে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছিলেন অবশ্য কিছু ব্যতিক্রম ছিল যা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে।মুসলিম সংখ্যাধিক্যের জন্য পাকিস্থান কাশ্মীরের দবি জানাতে থাকে।এরপরেই দ্রুত ঘনিয়ে আসে সংঘাতের ছায়া। ১৯৪৭ সালের ২৪ শে আগষ্ট জিন্না তাঁর সামরিক সচিবকে জানানতিনি কাশ্মীরে দু সপ্তাহ ছুটি কাটাতে চান। কিন্ত হরি সিং তাঁকে কাশ্মীরে পদার্পনের অনুমতি দিলেন না। ১৯৪৭ সালের ৩০ শে সেপ্টেম্বর পাকিস্থান রাষ্ট্রপুঙ্জের সদস্য নির্বাচিত হয়। সুতরাং পাকিস্থানের পক্ষে সরাসরি কাশ্মীরে সেনা পাঠানো সম্ভব ছিল না।উদ্ভুত পরিস্থিতিতে জিন্ন উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের (বর্তমান খাইবার পাখসতুনওয়া) পাখসতুন উপজাতির নেতাদের অক্টোবরের শেষদিকে কাশ্মীর আক্রমণ করার জন্য রাজি করান।এই সিদ্ধান্তের দ্বারা তিনি অনেকগুলি উদ্দেশ্য সাধন করার চেষ্টা করেন- প্রথমত, পাকিস্থানি সেনা ব্যবহার না করেই কাশ্মীর দখল করা যাবে। দ্বিতীয়ত, কাশ্মীরী জনগনকে বোঝান যাবে যে বিধর্মীদের হাত থেকে তাদর মুক্তি দিয়ে ইসলামি রাষ্ট্রের অংশিদার করা ল।তৃতীয়ত, পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাখসতুন উপজাতির কাবুলের ছত্রছায়া থেকে সরিয়ে আনা। কারণ পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সীমানা নিয়ে পাখসতুন উপজাতিদের উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আফগান সরকারের সাথে ব্রিটিশদের বিবাদ ছিল যা পাকিস্থানের উৎপত্তি লাভের পর আরও জটিল হয়। এজন্য রাষ্ট্রপুঙ্জে পাকিস্থানের সদস্য নির্বাচিত হবার সময় একমাত্র আফগানিস্থান আপত্তি জানায়। সেই সময় হত্যা, লুঠ, সংঘর্ষ ছিল পাখসতুন সমাজে দৈন্দিন ব্যাপার এবং বীরত্বের বহ:প্রকাশ। এজন্য পাখসতুনরা ব্রিটিশ সরকারে নথিতে উপদ্রুত উপজাতি হিসাবে নথিভুক্ত ছিল হেন পাখসতুনদের এই বলে কাশ্মীর আক্রমন করার জন্য রাজি কারন হয় যে, হিন্দু রাজার কবল থেকে মুসলিম ভাইদের উদ্ধারের ধর্মযুদ্ধের পরই পাওয়া যাবে অবাধ লুঠের সুযোগ। ভাড়াটে লুটেরার দল ২২-২৩ শে অক্টোবর ঝিলাম নদী পার হয়ে কাশ্মীরে প্রবেশ করল। সামান্য প্রতিরোধের পর সীমান্ত চৌকিগুলি দখল হলে পাখসতুন হনাদারেরা ১৪০ মাইল দূরে অবস্থিত কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর দখল করার আদেশ পায় কিন্তু ভড়াটে সেনার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রাতের অন্ধকারে লুঠের আশায় নিকটবর্তী মুজাফারাবাদে পালিয়ে যায়। এর ফলে শ্রীনগর অভিযান বিলম্বিত হয় হানাদারের সংখ্যা হ্রাস পায়। তৎসত্ত্বেও অবশিষ্টাংশ হানাদারেরা বারামূলা হয়ে শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় যাত্রাপথে মাহুলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বিস্ফোরণে নষ্ট করে।এসময় ডোগরারা (দেবী দূর্গার ভক্ত)দূর্গা উৎসব দশেরায় ব্যস্ত ছিল, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস হবার ফলে সমগ্র শ্রীনগর শহর অন্ধকারে ডুবে যায়। রাজার সেনারা সামান্য প্রতিরোধে সামর্থ হয়। ফলে ২৩ তারিখ রাতে হানাদারেরা শ্রীনগর থেকে মাত্র পঞ্চাশ মাইল দূরে অবস্থান করে। শ্রীনগরে সেসময় প্রশাসন বলতে কিছু ছিল না, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা অচল। সেই পরিস্থিতিতে শেখ আব্দুল্লার নেতৃত্বে ন্যাশনাল কনফারেন্সের সদস্য স্বেচ্ছাসেবকরা হিন্দু-মুসলমসন-শিখ সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বাতাবরণ বজায় রেখে নাগরিক জীবন সচল রাখেন।

রাজা হরি সিং
Courtesy-
Getty Images 

           
২৪ শে অক্টোবর হরি সিং বাধ্য হয়ে ভারত সরকারের কাছে সেনা সা্হায্য প্রার্থনা করেন শেখ আব্দুল্লা কাশ্মীরে ভারতীয় সেনা আহ্বানের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানালেন।কিন্ত ব্যবস্থার বৈধতা দেখার জন্য নেহেরু ২৫শে অক্টোবর সকালে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক ডাকলেন।উক্ত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় কাশ্মীরের ভারতভুক্তি ছাড়া সেনা পাঠানো হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশ তা মেনে নেবে না। মন্ত্রীপরিষদের সুপারিশ আনুসারে দেশীয় রাজ্য মন্ত্রকের সচিব ভি.পি. মেননকে দিন বিকালে বিমান বাহিনীর একটি ডগলাস ডি.সি. বিমানে করে শ্রীনগরে পাঠানো ল।তাঁর দৌত্যের উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীরের ভারতভুক্তির কাগজে হরি সিং- স্বাক্ষর নেওয়া। কিন্তু রাজার সাথে প্রাথমিক আলোচনার পর তিনি দিল্লী ফিরে এলেন।ইতিমধ্যে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়লে ২৬ তরিখ হরি সিং জনগণকে অসহায় অবস্থায় রেখে সপর্ষদ শীতকালিন রাজধানী জম্মুতে পলায়ন করেনফলে ২৬ তারিখ, মেনন বিমানযোগে জম্মু উপস্থিত হয়ে হরি সিং কাছ থেকে কাশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্তির কাগজে সই নেন।


২৭ শে অক্টোবর ১৯৪৭ শ্র্রীনগর বিমানবন্দরে শিখ রেজিমেন্টর আগমন।     Courtesy- indiandefence review

   উক্ত চুক্তি অনুসারে জম্মু-কাশ্মীর,গিলগিট-বাল্টিস্থান, লাদাক এবং আকসাই চিন ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত হয়। ২৭ তারিখ সকালে প্রথম শিখ রেজিমেন্টকে বিমানযোগে শ্রীনগর পাঠনো হয়। খুব সহজেই পাকিস্থানী হানাদারেরা শ্রীনগর থেকে অপসারিত হয় কিন্তু দূর্গম স্থানগুলিতে পাক হানাদারেরা যথেষ্ঠ স্বক্রিয় থাকে যখন জিন্না ভারতীয় সৈন্যদের অবতরণের বিষয়ে জানতে পারলেন, তখন তিনি পাকিস্থানস্থ ব্রিটিশ বাহিনীর কমান্ডার-ইন-জেনারেল স্যার ডগলাস গ্রেসিকে রাওয়ালপিন্ডি   সিয়ালকোট থেকে দুটি ব্রিগেড নিয়ে কাশ্মীরে রওনা হবার  নির্দেশ দেন তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সিয়ালকোটের ব্রিগেড জম্মু দখল করে হরি সিংকে আটক করবে এবং রাওয়ালপিন্ডির ব্রিগেড শ্রীনগরের অধিকার নেবে কিন্তু গ্রেসি ফিল্ড মার্শাল স্যার ক্লাউড অচিনলেকের (১৯৪৭ সালের আগষ্টে অচিনলেককে ভারত পাকিস্থানস্থিত সমস্ত ব্রিটিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ কামান্ডার হিসাবে নিয়োগ করা হয়)অনুমোদন ছাড়া সেনা অভিযানে রাজি হলেন না। ক্লাউড অচিনলেক ভারত পাকিস্থানের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের আশঙ্কায় পাকিস্থানের সেনাভিযানে সম্মতি দিলেন না।১৯৪৭ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর নেহেরু জাতিপুঙ্জে পাক হানাদারের আধিনে থাকা কাশ্মীরের অংশ নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করেন। কিন্তু পাকিস্থানের উপর কোন আন্তর্জাতিক চাপ দেখা গেল না।
কাশ্মীরের ভারতভুক্তির খবর

    Courtesy – Hindustan Times Archive  

 
১৯৪৮ সালের নভেম্বর মাসে স্যার ক্লাউড অচিনলেক অবসর নেওয়ার পর পাকিস্থান কাশ্মীরে সেনা পাঠায়,কিন্তু তখন পর্যন্ত ভারতীয় বাহিনী প্রায় দুই তৃতীয়াংশ রাজ্য নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলেছিল মুজাফারাদাবাদ,চিত্রাল,গিলগিট-বাল্টিস্থান পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সাথে পাখসতুন উপজাতি পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে, যা ১৯৪৮ ভারত-পাকিস্থান যুদ্ধ নামে পরিচিত।উক্ত যুদ্ধে ভারতীয় সেনা যখন পুঞ্চের পশ্চিমে সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে আসছিল, তখন ( ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে) জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ভারত পাকিস্থান যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয় ১৯৪৯ সালের ৫ই জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।ফলে গিলগিট-বাল্টিস্থান, চিত্রাল মুজাফারাবাদ থেকে পাক হানাদার বাহিনীর আপসারণ আর সম্ভব হয়নি। উক্ত চুক্তিতে (United Nations Security Council Resolution 47)  বলা হয়,  
. পাকিস্থান তার নিয়মিত এবং অনিয়মিত উভয় বাহিনীকে প্রত্যাহার করবে,
. আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ভারত কাশ্মীরে নূন্যতম বাহিনী রাখবে,
.ভারত কাশ্মীরের সকল প্রধান রাজনৈতিক দলকে একটি জোট মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আমন্ত্রন জানাবে যারা স্বাধীনভাবে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন, সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য ব্যবস্থা গ্রহনে সমর্থ হবে।
. এরপর ভারত জাতিপুঙ্জ মনোনিত একজন আধিকারিককে নিয়োগ করবে যিনি স্বাধীনভাবে দুই দেশের নেতাদের কাশ্মীরী জনগনের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নিরপেক্ষ গণভোটের আয়োজন করবেন
.যতদিন না গণভোটের আয়োজন হচ্ছে, স্থিতবস্থা বজায় থাকবে।

      যে সময় এই যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হয় সেসময় ভারত কাশ্মীরের দুই-তৃতীয়াংশ এবং পাকিস্থান এক-তৃতীয়াংশ দখলে রেখেছিল। অধিকাংশ নিরপেক্ষ মূল্যায়ণগুলি একমত যে, ভারত যুদ্ধের বিজয়ী ছিল কারণ কাশ্মীর উপত্যকা, জম্মু লাদাখ সহ প্রায় দুই তৃতীয়াংশ কাশ্মিরী ভূ-খন্ড সফলভাবে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল ভারত পাকিস্থান উভয়ই জাতিপুঙ্জের এই প্রস্তাব (Resolution 47) মানতে রাজি ছিল না।

ভারতের যুক্তি ছিল-
. যেভাবে Resolution 47- পাকিস্থান ভারতকে এক সারণীতে রাখা হয়েছিল তা অন্যায়। কারণ পাকিস্থান কাশ্মীর হামলা করেছিল কিন্তু ভারত ১৯৪৭ সালের ২৬ শে অক্টোবর অবিভক্ত ভারত সরকারের ১৯৩৫ সালের আইন অনুসারে কাশ্মীরকে অধিগ্রহন করে যাতে  কাশ্মীরের সব থেকে বড় রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের সম্মতি ছিল।
. ভারত কাশ্মীর থেকে সেনা সরাতে রাজি হয়নি কারন সেনা সরালে পুণরায় পাকিস্থানের হমলার আশঙ্কা ছিল।
. ভারত মনে করে জোট মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব মানলে শেখ আব্দুল্লার  প্রভাব হ্রাস পাবে যা কাশ্মীরের সর্বভৌমত্বকে আঘাত করবে।
.ভারত অবশেষে দাবি করে গনভোট সংগঠনের ক্ষেত্রে পাকিস্থানকে বাইরে রাখতে হবে কারন পাকিস্থান অন্যায় ভাবে কাশ্মীরের এক উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে রেখেছে।

অপরপক্ষে পাকিস্থানের যুক্তি ছিল-

. সামান্য ভারতীয় সেনাও যদি থাকে(আইন-শৃক্ষলা রক্ষায়) তাহলে নিরপেক্ষ গনভোট সম্ভব নয় তাই যতক্ষন  ভারতীয় সেনার পূর্ণ অপসারণ হচ্ছে পাকিস্থান গণভোটে যাবে না।
. পাকিস্থান উপস্থাপিত জোট মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের পঞ্চাশ শতাংশ অংশদারিত্ব দাবি করে।
. সবশেষে পাকিস্থান এই বলে Resolution 47 মানতে অস্বীকার করে যে, প্রাথমিক পর্যায়ে নিরাপত্তা পরিষদ পাকিস্থানের অনুকূলে সিদ্ধান্ত নিলেও আমেরিকা ব্রিটেনের চাপে অধিকাংশ সিদ্ধান্ত ভারতের পক্ষে ছিল।তাছাড়া, ভারত যে ভাবে যুক্তিতে (পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে) জুনাগড়ের অধিকার লাভ করেছিল সেই যুক্তিতে পাকিস্থান কাশ্মীরের উপর ভারতের দাবিকে নস্যাৎ করে নিজ অধিকার দাবি করে।

    নেহরু সর্দার প্যাটেলের চাপে হরি সিং তাঁর পুত্র, যুবরাজ করণ সিংকে জম্মু কাশ্মীরের প্রশাসক জনপ্রিয় কাশ্মীরী নেতা শেখ আব্দুল্লাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ করতে বাধ্য হন। ৩১ শে অক্টোবর শেখ আব্দুল্লা পাকিস্থানের উদ্দেশ্যে শান্তির বার্তা পাঠালেন কিন্তু কোন সাড়া পেলেন না।১৯৫২ সাল পর্যন্ত করণ সিং ছিলেন কাশ্মীরের 'সদর--রিয়াসাত' ('রাষ্ট্রের প্রধান')১৯৫২ সালে রাজতন্ত্রের অবসানের পর ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত করণ সিং ছিলেন রাজ্যপাল। অপরদিকে পাকিস্থান মুজাফারাদাবাদ,চিত্রাল,গিলগিট-বাল্টিস্থানকে নিয়ে গঠন করে আজাদ কাশ্মীর যার রাজধানী হয় মুজাফারাদাবাদকাশ্মীর সমস্যা আন্তর্জাতিক রূপ নেওয়ায় ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯৫১ সালে কাশ্মীরে সাধারণ নিবার্চন আনুষ্ঠিত হলে ন্যাশনাল কনফারেন্স সব আসনে জয় লাভ করে।

    ১৯৫৩ সালের ৮ই আগষ্ট করণ সিংকাশ্মীর ষড়যন্ত্রমামলার দায়ে বা অজুহাতে শেখ আব্দুল্লাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং এগারো বছরের জন্য জেলে প্রেরণ করেন তাঁর স্থলাভুক্ত হন তাঁরই সহকর্মী বক্সী গুলাম বেগ।শেখ আব্দুল্লার মতে অন্যের মন্ত্রনায় নেহেরুর প্রত্যক্ষ্য মদতে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। অবশেষে ১৯৬৪ সালের ৮ই এপ্রিল শেখ আব্দুল্লাকেকাশ্মীর ষড়যন্ত্রমামলা থেকে অব্যহতি দিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির পর তিনি শ্রীনগরে উপস্থিত হলে জনগন তাঁকে বরণ করে নেয়। মুক্তির পর নেহেরুর সাথে তাঁর হৃত সম্পর্ক পুনরুদ্ধার হতে শুরু করে।অত:পর নেহেরু তাঁকে দিল্লী এসে কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ি সমাধানের জন্য বৈঠকের আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান টেলিগ্রাম করে নেহেরু শেখ আব্দুল্লাকে জানান পাকিস্থানের অংশিদারিত্ব সম্মতি ছাড়া কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে গৃহিত কোন পদক্ষেপ মানা হবে না। সুতরাং, নেহেরুর সম্মতিক্রমে শেখ সাহেব ১৯৬৪ সালের বসন্তে পাকিস্থান সফরে যান। আয়ুব খানের সাথে তাঁর দীর্ঘ আলোচনার পর কাশ্মীর সমস্যার খসড়া সমঝতা প্রস্তুত হয় পাক প্রেসিডেন্টকে জুনের মাঝামাঝি দিল্লীতে আসতে রাজি করান। এভাবে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের এক উজ্জ্বল সম্ভবনার সৃষ্টি হয়। এর পরেই শেখ আব্দুল্লা  পাক অধিকৃত কাশ্মীর সফরে যান কাশ্মীরী জনগণ নেতাদের সাথে মত বিনিময় করতে থাকেন। ২৭ শে মে যখন তিনি মুজাফারাদাদের পথে ছিলেন, নেহেরুর মৃত্যু সংবাদ পান। খবর পাওয়া মাত্র তিনি দিল্লী রওনা হন। পাক প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান নেহেরুর অন্ত্যেষ্টিতে বিদেশ মন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর নেতৃত্বে এক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠান। এভাবে ইতিহাসে ভারত-পাকিস্থান কাশ্মীরের সমস্যা সমাধানে  যে সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল তা ব্যর্থ হয়।
২০১৮, অশান্ত কাশ্মীর
             Courtesy – The Statesman   

  
পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনার  আবর্তে কাশ্মীর সমস্যা আরও জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে এবং ভারত- পাকিস্থান সংঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি পায় যার চূড়ান্ত ফল বর্তমান সময়ের অশান্ত, হিংসা-বিদীর্ণ কাশ্মীর। যে কাশ্মীর ছিল সুফিবাদের চারণভূমি তা আজ অসহিষ্ণুতার বিষবাষ্পে কলুষিত। বর্তমানে কাশ্মীরী যুব সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য অংশ নানা করণে ভারত বিদ্বেষী হিংসাশ্রয়ী রাষ্ট্রশক্তি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে, যার ফলে কাশ্মীরী জনগণের অসন্তোষ বাড়ছে। বহুকাল আগে কলহন যথার্থই বলেছিলেন- “কাশ্মীরকে জয় করা যায় আত্মিক মেধার শক্তিতে, সৈন্যবাহিনীর অস্ত্রবলে কখনই নয় নিজেদের সম্বন্ধে কাশ্মীরীদেরও ইরকম বিশ্বাস। তাই বলপ্রয়োগ নয়, সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই কাশ্মীরী জনগনের আস্থা অর্জন করা উচিত।
 

লকডাউনে মদ্যপান! তারপর? একটু ভাবুন ….

দিল্লীতে লকডাউন চলাকালীন সুরা প্রেমীদের তান্ডাব                photo courtesy: twitter     লকডাউন ঘোষণার প্রায় দেড় মাস পর সরকার সিদ্ধ...