ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মূল চালিকা
শক্তি নিহিত আছে বহুত্ববাদী মতাদর্শে। এই বহুত্ববাদী
মতাদর্শের আকরস্থল হল বৈচিত্র্যময় ভারতীয় সংস্কৃতি। রাষ্ট্র নির্মাণ ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের
সৃষ্টিলগ্নে আমাদের সংবিধান প্রণেতাগণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অখন্ডতা
রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম, জাত ও মতের
সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান ভারতীয় গণতন্ত্রের ভীতকে যেমন পোক্ত করেছে,সফল জাতি
হিসাবে আমাদের গরিমাকেও বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।কিন্তু বর্তমানে পরিবর্তিত
পরিস্থিতিতে ভারতীয় সংস্কৃতির এই বহুত্ববাদী মতাদর্শ আজ আক্রান্ত। তাই সময় এসেছে
ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যকে পুনরায় স্মরণ করা এবং কীভাবে তা ঐতিহাসিক
কাল থেকে আমাদের রাষ্ট্র নির্মাণে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে তা উপলদ্ধি করা।‘বৈচিত্র্যের
মধ্য ঐক্য’ কথাটির প্রকৃত অর্থ বিভিন্ন সংস্কৃতি, মতবাদ ও ভাবধারার সৌহাদ্যপূর্ণ সহাবস্থান।
এজন্য হার্বাট রিজলি যথার্থই বলেছেন- “প্রাকৃতিক এবং সমাজিক, ভাষা, আচার-আচরণ ও
ধর্মগত বিভিন্নতার অন্তরালে হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ভারতবাসীর মনে ঐক্যের
স্রোত প্রবহমান”। বিপুল ভৌগলিক বিস্তার ও জনগোষ্ঠী সমন্বিত এদেশে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক
যে বৈচিত্র্য দেখা যায় তাতে ভারতবর্ষকে একটি মহাদেশ বলে মনে হয়। তাই আমাদের
জন্মভূমিকে সমগ্র ‘বিশ্বের সারাংশ’ (Epitome of the world) বলা যায়।এই প্রবন্ধে আমরা
আলোচনা করবো ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের স্বরূপ
এবং সেই বৈচিত্র্য কিভাবে রাষ্ট্রীয় ঐক্য নির্মাণে সহায়ক হয়েছে তার ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক
প্রেক্ষাপট।
বিভিন্ন নৃতত্ত্ব-ভাষা-জাতিগত
ঐতিহ্য, শিক্ষা, জীবনশৈলি এবং মতাদর্শের সমাহার ও সহাবস্থানের পুঞ্জিভূত রূপকে বলা
হয় সংস্কৃতি। বৈচিত্র্যের প্রাচুর্য্য যেকোন সংস্কৃতির মূলাধার। কোন একটি
মতাদর্শের প্রাধান্য সৃষ্টি করে রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্র ও একঘেয়েমিতা। সভ্যতার
উষালগ্ন থেকে ভারতবর্ষ বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, ভাষা ও মাতাদর্শের মিলনভূমি। ভিনসেন্ট স্মিথ এ প্রসঙ্গে বলেছেন- “ India is an ethnological museum”। আশ্চর্যের
হলেও সত্যি ভারতে প্রাগৈতিহাসিক মানব কঙ্কাল সামান্যই পাওয়া গেছে, তাই প্রাচীনকালে
কোন প্রকার মানবগোষ্ঠী এখানে বসবাস করত তা জানা যায় না। ভারতে যে নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য
লক্ষ্য করা যায় তা মূলত পরিব্রাজনের ফল। ইংরেজ নৃতাত্ত্বিকগণ ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে
সাতটি ভাগে ভাগ করেছেন; যথা- মঙ্গোলীয়, আর্য, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয়-দ্রাবিড়, দ্রাবিড়ীয়-আর্য,
শক-দ্রাবিড়ীয় এবং তুর্কী-ইরানীয়। পরবর্তীকালে ড: বি.গুহ ও জে.এইচ্ হাটন্ ভারতীয়
জনগোষ্ঠীকে ছয়টি শ্রেণীতে ভাগ করেন, যথা- নিগ্রো জাতির কৃষ্ণবর্ণের মানুষ,
প্রোটো-অষ্ট্রেলীয়,মঙ্গোলীয়, ভূমধ্যসাগরীয়, আলপাইন-আর্মেনিয়ড, নর্ডিক। হাজার হাজার
বছর ধরে পারস্পারিক সংমিশ্রণে এই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলি মিলেমিশে একাকার হয়েছে। যেমন নর্ডিক
বা আর্যদের সাথে ভূমধ্যসাগরীয় গোষ্ঠীর সংমিশ্রণে উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় জনগোষ্ঠীর
সৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিণ ভারতীয়রা মূলত ভূমধ্যসাগরীয় জনগোষ্ঠী। কিন্তু তাদের সাথে
প্রোটো-অষ্ট্রেলীয়দের সংমিশ্রণ দেখা যায়, এজন্য দক্ষিণ ভারতে কৃষ্ণবর্ণের
প্রাধান্য দেখা যায়। আবার পূর্ব ভারতের জনসাধারণ মূলত প্রোটো-অষ্ট্রেলীয় ও মঙ্গোলীয়
জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত রূপ।
সংখ্যাগত
বিচারে ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বহুভাষী দেশ। সমগ্র দেশে প্রায় ৭৮০ টি ভাষা
নথিভূক্ত হয়েছে। ভারতীয় ভাষা সমূহের বিবর্তণ হয়েছে ৪ টি ভাষা শ্রেণী থেকে;
যথাক্রমে - অষ্ট্রিক, চীনা-তিব্বতীয়, দ্রাবিড়ীয়, ইন্দো-ইরানীয়। ৭৮.৫ শতাংশ ভারতীয়
জনগণ ইন্দো-ইরানীয় ভাষাসমূহ যেমন- হিন্দি, গুজরাটী, মারাঠী, মাড়োয়ারী, ভোজপুরী,
বাংলা, ওড়িয়া, অসমীয়া প্রভৃতি ভাষায় কথা বলেন। অন্যদিকে,
১৯.৬৮ শতাংশ জনগণ বিভিন্ন দ্রাবিড়ীয় ভাষা যেমন তামিল, তেলেগু, মালায়ালম, কন্নড়
প্রভৃতি ভাষায় মনের ভাব আদান – প্রদান করেন। ভারতীয়
সংবিধানের ৩৪৩ নং ধারায় ২২ টি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ১৯৫৬ সালে রাজ্য
পুনর্গঠনের অন্যতম ভিত্তি ছিল ভাষা। অর্থ্যাৎ ভাষাগুলির আঞ্চলিক কেন্দ্রীভবন
পরিলক্ষিত হয়। উত্তর ভারতে যেমন ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রাধান্য রয়েছে, তেমনি
হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল ও উত্তর-পূর্ব ভারতে রয়েছে চীনা-তিব্বতীয় ভাষাগুলির প্রাধান্য।
দক্ষিণ ভারতীয়রা মূলত দ্রাবিড়ীয় ভাষা ব্যবহার করেন এবং মধ্যভারতের উপজাতি জনগনের
মাতৃভাষায় অষ্ট্রিক প্রভাব সুস্পষ্ট।
ভারতভূমি
পৃথিবীর অন্যতম চারটি প্রধান ধর্ম যথাক্রমে, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মের
উৎপত্তিস্থল। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে ৭৯.৮ শতাংশ ভারতীয় জনগণ হিন্দু, ১৪.২
শতাংশ ইসলাম, ২.৩ শতাংশ খ্রীষ্টান, ১.৭ শতাংশ শিখ, ০.৭ শতাংশ বৌদ্ধ এবং মাত্র ০.৪
শতাংশ জৈন ধর্মাবলম্বী। হিন্দু ধর্ম পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম যা বিভিন্ন মত
ও শাখায় বিভক্ত। কিন্তু হিন্দু ধর্মই ভারতীয় সভ্যতার প্রধান চালিকা শক্তি।
পরবর্তীকালে হিন্দু ধর্ম থেকে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সৃষ্টি হয়। এরপর ৯৯৮ খ্রীষ্টাব্দে
গজনির সুলতান মামুদের সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে ভারতে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। মুঘল আমল
ছিল ভারতে ইসলামী শাসনের সুবর্ণ যুগ। মুঘল আমলের মধ্যবর্তী পর্যায়ে ইসলাম ও হিন্দু
ধর্মের সংমিশ্রণে যে নতুন ধর্মের সূচনা হয় তা হ’ল শিখ ধর্ম। ইসলাম ও খ্রীষ্টান
ধর্ম বহি:শক্তির দ্বারা এদেশে প্রবেশ করলেও কালক্রমে তাদের ভারতীয়করণ ঘটেছে।
প্রথাগত ভারতীয় ধর্মগুলির সাথে এই দুই ধর্মের সহাবস্থানের মাধ্যমে এক অনন্য বৈচিত্র্যের
সৃষ্টি হয়েছে, যা সারা বিশ্বে ব্যতিক্রম। অপরপক্ষে বৌদ্ধ ধর্ম ভারতে উৎপত্তি লাভ
করে পূর্ব, মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃতি লাভ করলেও ভারতে হিন্দু ধর্মের
প্রভাব অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়েছে।কালক্রমে বৌদ্ধ ধর্ম হিন্দু ধর্মের এক সহচরে
পরিণত হয়। যার ফলশ্রুতি স্বরূপ গৌতম বুদ্ধ হিন্দু ধর্মের অবতার হিসাবে পূজিত হন।
ভারত
বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, ধর্মাবলম্বী ও ভাষা-ভাষীর এক মিলনক্ষেত্র। ভারতবাসীর
জীবনযাত্রা ও দৈনন্দিন কার্যকলাপের উপর উক্ত বিষয়গুলির সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা
যায়। তাছাড়া জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতিকগত পার্থক্যের জন্য একই নৃতাত্ত্বিক বা
ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জীবিকা, খাদ্যাভাস, পোষাক-পরিচ্ছদ ও রন্ধনশৈলীর মধ্যে বিস্তর
পার্থক্য ঘটে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের রন্ধনশৈলীতে আরব ভূখন্ড
ও মধ্য এশিয়ার প্রাভাব দেখা যায়। এই রন্ধনশৈলীতে মশলার প্রাচুর্য্য ও আমিষ দ্রব্য
ব্যবহারের আধিক্য রয়েছে। অন্যদিকে জৈনদের খাদ্য সামগ্রী সম্পূর্ণ আমিষ বর্জিত।
আবার উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণ সমাজ মূলত নিরামিশাষী হলেও পূর্ব ভারতের
ব্রাহ্মণরা ঘোরতর আমিষাশী।এটাই নয়, হিন্দু ধর্মের অন্য শ্রেনী বা গোষ্ঠীর মধ্যে
খাদ্যাভাসের আরও বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়, যেমন মৎস্য ভগবান বিষ্ণুর অবতার রূপে
পূজিত হবার কারণে উত্তর ভারতীয় হিন্দুদের খাদ্য তালিকায় অবাঞ্ছিত। অথচ পূর্ব ও
দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ হিন্দুদের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। জলবায়ু ও সাংস্কৃতিক
বৈচিত্র্যের কারণে পোষাক-পরিচ্ছদে প্রাদেশিক বৈচিত্র্য লক্ষ্যণীয়; যেমন- উত্তর
ভারতীয় রমণীদের মধ্যে সালোয়াড়-কামিজ অধিক জনপ্রিয়, দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে শাড়ির
প্রচলন অধিক। কম আর্দ্রতা ও অধিক উষ্ণতার জন্য উত্তর ও পশ্চিম
ভারতের পুরুষরা শিরস্তান ব্যবহার করলেও অধিক আর্দ্রতার কারণে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে
তার ব্যবহার সীমিত।
সমগ্র
দেশে ইসলাম, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে সাদৃশ্য ধাকলেও
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসবগুলির মধ্যে প্রাদেশিক ভিন্নতা রয়েছে। দূর্গা্পূজা
পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম এবং ঝাড়খন্ড ও উড়িষ্যায় বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পালিত
হলেও, একই উৎসব গুজরাটে নবরাত্রি এবং দেশের বাকি অংশে দশেহরা হিসাবে পালিত হয়।সমগ্র মহারাষ্ট্রে এবং গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশের
কিয়দাংশে গণেশ চতুর্থী মহাসমরোহে পালিত হলেও অন্যান্য প্রদেশে এই উৎসবের প্রচলন কম।
বনবাস শেষে রামচন্দ্র ও সীতার অযোধ্যায় প্রত্যাগমনের শুভ মুহুর্ত দেশের অধিকাংশ
স্থানে দীপাবলীর মাধ্যমে উদযাপিত হলেও বাঙালী ও অসমীয়ারা সেই সময় কালীকার আরাধনায়
রত থাকেন।সমগ্র দেশে খরিফ শস্য উত্তোলনের পর্যায়ে যে উৎসব হয় তাতেও আঞ্চলিক তথা
প্রাদেশিক বৈচিত্র্য বিদ্যমান; যেমন পশ্চিমবঙ্গে যা নবান্ন নামে পরিচিত বিহার-উত্তরপ্রদেশ-মধ্যপ্রদেশে তা মকরসংক্রান্তি,
তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, আসামে মাঘ বিহু, পাঞ্জাবে লোহরি, গুজরাটে উত্তরায়ন নামে
পরিচিত।এপ্রিলের মাঝামাঝি প্রাদেশিক ক্যালেন্ডার গুলিতে নতুন বছর শুরু হয় এবং এই
উপলক্ষে যে উৎসব হয় যার নামকরণেও বৈচিত্র্য আছে যেমন পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ, পাঞ্জাবে বৈশাখী, আসামে রঙ্গলী বিহু
ইত্যাদি।
ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে ঐক্যবন্ধনের কাজ করেছে সংস্কৃত ভাষা। হিন্দু
সংস্কৃতির বিস্তারের সাথে সাথে ভারতে সংস্কৃত ভাষারও সম্প্রসারণ ঘটে। যা থেকে
পরবর্তী কালে উদ্ভুত হয় বিভিন্ন ইন্দো-ইরানীয় ভাষা সমূহ। প্রাথমিক পর্বে দ্রাবিড়ীয়
ভাষাগুলি সংস্কৃতের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল। কিন্তু
আর্য সংস্কৃতির বিস্তারের সাথে সাথে তামিল, তেলেগু, মালায়ালম, কন্নড় প্রভৃতি ভাষায়
সংস্কৃত শব্দমালা ও ব্যকরণের সমূহ প্রভাব পড়ে।প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃত ছিল প্রাক ইসলামীয় শাসকগোষ্ঠীর ভাষা। এরপর
মুসলিম প্রশাসকদের আগমনের পর হিন্দি ও ফার্সী-র মিশ্রণে উর্দু ভাষার জন্ম হয়। ব্যকরণগত
দিক থেকে উর্দু ভাষা হিন্দির অনুরূপ কিন্তু ফার্সী লিপিতে লেখা হয়।হিন্দি ও উর্দুর
বহুল ব্যবহার উত্তর ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংযোজকের ভূমিকা পালন করে। অনুরূপভাবে,
ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার ফলস্বরূপ ইংরাজী ভাষা উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের অধিবাসীদের
মধ্যে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। এইভাবে হিন্দি-উর্দু, ইংরাজী ভাষা
সমগ্র জাতিকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে।
ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ যথার্থই বলেছিলেন, “ ভারতের ইতিহাসের প্রধান
বৈশিষ্ট্যই হ’ল সাংস্কৃতিক সমন্বয়”। ব্রটিশ শাসনের পূর্বে ভারতের রাষ্ট্রীয়
আর্দশের উপর ধর্মীয় প্রভাব ছিল প্রশ্নাতিত।প্রাথমিক পর্বে সনাতন হিন্দু ধর্মের
পেলব আশ্রয়ে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলির বিভাজন দূরীভূত হয় ও পারস্পারিক
সংমিশ্রণের মাধ্যমে ভারতীয় জনগোষ্ঠীর অবয়ব নির্মিত হয়। প্রাচীনকালে বিভিন্ন হিন্দু
তীর্থস্থলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আগমন ও মেলামেশা
সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ হিন্দু ধর্মের আচার আচারণ যেমন প্রাক
ইসলমীয় ভারতীয় সংস্কৃতির পরিকাঠামো নির্মাণ করে তেমনি রাষ্ট্রীয় ঐক্যেরও সূচনা করে। মৌর্য্য, গুপ্ত ও নন্দ রাজবংশ প্রাচীনকালে রাষ্টীয়
ঐক্য স্থাপনে প্রয়াসী হয়। পরবর্তীকালে ইসলামী শাসকশ্রেণী বর্হিদেশীয় হয়েও তাদের
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন কারণ তারা ইসলামের সাথে ভারতীয়
ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। পরে তারা ক্রমশ
ভারতীয় সাংস্কৃতি ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন এবং এইভাবে ইসলামের ভারতীয়করণ
ঘটে। ইসলামের এই পরিমার্জিত রূপ সুফিবাদ নামে পরিচিত।প্রকৃতপক্ষে সম্রাট আকবরের
দীন-ই-ইলাহী মতবাদ ভারতীয় হিন্দু জনগণের হৃদয় জয় করে ও শাসক হিসাবে মুঘলরা
প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। অধিকাংশ মোঘল সম্রাটরা ধর্মীয় অনুশাসনের উর্ধ্বে
উঠে প্রশাসক হিসাবে রাষ্টীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তিতে ব্রিটিশরা অনুসরণ
করে। ব্রিটিশ কুশাসনের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধি, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ও
অন্যান্যদের নেতৃত্বে ধর্ম-বর্ণ-জাত নির্বিশেষে সমগ্র ভারতবাসীর আপোসহীন আন্দোলনের
ফলশ্রুতি হ’ল ভারতের স্বধীনতা।এই পর্বে ভারত কেবল একটি ভূ-খন্ড নয় জাতি (Nation) হিসাবে উদ্ভাসিত হয়।এতদসত্ত্বেও দ্বি- জাতি তত্ত্বের
ভিত্তিতে আমরা দেশবিভাজনের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছি। কিন্তু
আজও আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষ। সংবিধান সকল ধর্মের সমানাধিকারের কথা বলে।
স্বাধীনতা
লাভের পর রাজনৈতিক নানা পটপরিবর্তন সত্ত্বেও জাতীয় ঐক্য কখনো লঙ্ঘিত হয়নি।কারণ ভারতীয়
সংবিধানের কিছু অনন্য পদক্ষেপ যেমন মৌলিক
অধিকার, স্বাধীন ভাবে ধর্মাচরণের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক স্বীকৃতি,
বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের সফল প্রয়োগ সকল ভাষা-ভাষী ও
সম্প্রদায়গুলির মধ্যে আত্মিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে। ফলত এত বৈচিত্র্য থাকা
সত্ত্বেও অমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আত্মবিশ্বাস লাভ করেছি যা আমাদের জাতীয়
ঐক্যকে সুসংহত করেছে। আজও আমরা এক দেশ, এক জাতি হিসাবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে
রেখেছি।তাই কবি যথার্থই বলেছেন-“ নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে
দেখ মিলন মহান”। এই মিলনের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় কোন রাষ্ট্রীয় কীর্তি বা সঙ্কট
কালে। যেমন-২০১১ সালে জাতীয় দল ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতার পর দেশের সমগ্র অধিবাসীদের মধ্য ব্যাপক উদ্দীপনার
সঞ্চার ঘটে, আবার ২০১৯ সালে পুলওয়ামাতে ভারতীয় সেনার কনভয়ে জঙ্গী হামলার পর সারা
দেশে সেনাবাহিনীর প্রতি সহমর্মীতার প্রকাশ দেখা যায়।ভারতীয় জাতীয়তাবাদের
প্রাণশক্তি নিহিত আছে বহুত্ববাদী মাতাদর্শের বহঃপ্রকাশের মধ্যে এবং ভারতীয় সংবিধান
আমাদের সে সুযোগ প্রদান করেছে।কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করলে
দেখা যায়, এই বহুত্ববাদী মতাদর্শ চরমপন্থী ভাবধারা দ্বারা আক্রান্ত। ফলে আমাদের
রাষ্ট্রীয় ঐক্যও আজ প্রশ্নের মুখে। মহাত্মা গান্ধী স্বাধীনতা প্রাক কালে এই আশঙ্কা
করেছিলেন এবং আমাদের সকলের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন-“ Our
ability to reach unity in diversity will be the beauty and the test of our
civilization”. রাষ্ট্রীয়
ঐক্য রক্ষার প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হ’ল সকল সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য অনুকূল
পরিবেশ নির্মাণ করা, যেখানে সকলের নিজস্ব জীবনযাত্রা, কর্মদক্ষতা, ও মতপ্রকাশের
পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। এইরকম পরিবেশ পাওয়া গেলে সকল সম্প্রদায় ও ভাষাগোষ্ঠীর
মানুষ সাবলম্বী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উন্নতর রাষ্ট্র নির্মানে উজ্জীবিত হবে।
No comments:
Post a Comment