আমাদের দেশ মৌসুমী জলবায়ুর অধীন। এদেশের কৃষিকাজ, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির উপর মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাব প্রশ্নাতীত। তাই যথার্থই আমাদের দেশকে ‘মৌসুমী জলবায়ুর দেশ’ বলা হয়। কিণ্তু বিগত কয়েক দশকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে, মৌসুমী বৃ্ষ্টিপাতের বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়।এই বৈষম্য যেমন অঞ্চলভিত্তিক তেমনি সময়ভিত্তিক। অর্থাৎ কোন এক স্থানে যখন বন্যা হয়, সেই সময়েই অন্য কোন স্থানে খরার ভ্রূকুটি দেখা দেয়। অনুরূপভাবে কোন এক স্থানে কোন এক বছরে যেমন স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয় তেমনি অন্য কোন বছরে সেই স্থানই আবার খরা বা বন্যার সম্মুখিন হয়। মৌসুমী বায়ুর এই খামখেয়ালিপনা কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। কিণ্তু মজার বিষয় হল, প্রায় প্রতি বছর এপ্রিল মাসে নিয়ম মাফিক দিল্লীর মৌসম ভবন দেশের সর্বএ স্বাভাবিক মৌসুমী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়।কিণ্তু বর্ষার অব্যবহিত পর এই মৌসম ভবনই আবার অঞ্চল ভিত্তিক বর্ষার ঘাটতি বা বন্যা পরিস্থিতির পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। মূলত দেশের শেয়ার বাজারের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার স্বার্থেই মৌসম ভবনকে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিতে হয়। অর্থাৎ মৌসুমী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস বর্তমানে প্রহসনে পরিনত হয়েছে।আবার বর্ষাকালে আঞ্চলিক আবহাওয়া দপ্তরগুলি যে স্থানভিত্তিক বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয় তারও গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে বহু প্রশ্ন আছে। শহরভিত্তিক এই আবহাওয়া দপ্তরগুলি যে দৈনিক পূর্বাভাস দেয় তা দূরবর্তী গ্রামগুলির অভিজ্ঞতার সাথে বহুলাংশে সামঞ্জস্যহীন।অথচ ফসলের রোপন, বপন, কর্তন এবং অন্যান্য আনুসঙ্গিক কার্যকলাপের উপর বৃষ্টিপাত, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, রৌদ্রজ্বলতা প্রভৃতির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ন।কৃষক বা গ্রামীন জনসাধারনের জীবনযাত্রার উপর স্থানীয় আবহাওয়ার প্রভাব নাগরিক সমাজ অপেক্ষা অধিক অথচ তারা উপেক্ষিত। দৈনিক আবহাওয়া বুলেটিনের সাথে তাদের অভিজ্ঞতার অমিল যথেষ্ট।সুতরাং সময় এসেছে বিকল্প পথ সন্ধানের।এখন প্রশ্ন হ’ল কি সেই পথ?
আলোচ্য প্রবন্ধে যে বিকল্প পথের সন্ধান দেওয়ার
চেষ্টা হয়েছে তার উৎস হ’ল আমাদের ঐতিহ্যগত
ধারণা ও অভিজ্ঞতা। এর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়েছে ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও কার্যকারণ
সম্পর্ক। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক ব্যক্তিই কম বেশি একজন আবহাওয়াবিদ। কারন তিনি
ব্যক্তিগত বা ঐতিহ্যগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দৈনিক আবহাওয়ার আভাস পেয়ে থাকেন, যা
বহুলাংশে সঠিক হয়।এই আভাস বা পূর্বাভাস আরও নিখুঁত হতে পারে যদি সেই ব্যক্তি
প্রকৃতির সহচর্যে থাকেন এবং গভীরভাবে প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেন। বস্তুত পুঁথিগতবিদ্যা
অপেক্ষা বাস্তব আভিজ্ঞতা অনেক বেশী কার্যকরী।
কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন সাধারন কৃষক
বা মৎস্যজীবি একজন পেশাদার আবহাওয়াবিদ অপেক্ষা বৃষ্টির পূর্বাভাস অনেক সঠিকভাবে
দিতে পারেন। যেভাবে ঐতিহ্যগত জ্ঞান (Traditional Knowledge) বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে, তেমনি তা স্থানীয় লক্ষণভিত্তিক আবহাওয়ার
পূর্বাভাসের ক্ষেত্রেও তা যথেষ্ট ফলপ্রসু। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ও আমাদের দেশের বিভিন্নাংশে স্থানীয় লক্ষণভিত্তিক
আবহাওয়ার পূর্বাভাস বেশ জনপ্রিয় এবং সে সর্ম্পকিত নানা প্রবাদবাক্য লক্ষ্য করা
যায়। এরকম দুটি ইংরাজি প্রবাদ হ’ল –
১. “Evening gray and morning red,
Bring down rain upon his head”.
অর্থ: সন্ধ্যার আকাশ যদি ধূসর এবং সকালের আকাশ যদি হয়
লাল, তাহলে বৃষ্টি অনিবার্য।
ব্যাখা: বাদলমেঘের সঞ্চার ঘটলে সন্ধ্যার আকাশ হ’য়
ধূসর এবং সকালে সূর্য্যোদয়ের সময় তা হ’য় লাল,যা ভালো বৃষ্টির পূর্বাভাস দেয়।
২. “Rainbow at evening, sailors’ delight,
Rainbow
in the morning, sailor takes warning”.
অর্থ: সন্ধ্যার সময় আকাশে রামধনু দেখে নাবিকরা আনন্দিত
হন এবং সকালে অনুরূপ হ’লে তাকে সতর্কবার্তা হিসাবে নেন।
ব্যাখা: সূর্য্যাস্তের সময় যদি আকাশে রামধনু সৃষ্টি
হয় তখন তা দেখা যায় পূর্বাকাশে। এ থেকে বোঝা যায় ঝড়টি ঐ
স্থান পেরিয়ে গেছে। সকালে রামধনু দেখা যায় পশ্চিমাকাশে, যা ঝড়ের আগমনকে
নির্দেশ করে।
গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গেও অনুরূপ বেশ কিছু প্রবাদ
পরিলক্ষিত হয় এবং সেগুলি বেশ জনপ্রিয়। এরকম একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হ’ল –
“পশ্চিমের ধনু নিত্য খরা।পুবের ধনু বর্ষে ধরা”। এটি ইংরাজি দু নম্বর প্রবাদের অনুরূপ।
অর্থ:পশ্চিমে রামধনু
অনাবৃষ্টির লক্ষণ এবং পূর্বের রামধনু উত্তম বৃষ্টির নিদের্শক।
আলোচ্য প্রবন্ধে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়ার
স্থানীয় লক্ষণভিত্তিক পূর্বাভাসকে মূলত তিনভাগে
ভাগ করা হয়েছে। যথা, প্রাকৃতিক
ঘটনাবলী (Indication of Natural Phenomenon) নির্দেশক , গাছপালা ও পশুপাখির আচরনগত (Behaviour of plants and animals) নির্দেশক এবং শারীরিক অনুভূতিগত (Physiological
Indication) নির্দেশক।
প্রকৃতি নিরীক্ষণ (Indication of Natural Phenomenon):
১. বৈশাখে
কালবৈশাখী ও জ্যৈষ্ঠে পরিষ্কার আকাশ – উত্তম মৌসুমী বর্ষার পূর্বাভাস
চৈএের অন্তিমলগ্নে ও বৈশাখের প্রারম্ভে রৌদ্রোজ্বল আবহাওয়া থাকলে গাঙ্গেয়
পশ্চিমবঙ্গে উত্তাপ জনিত কারণে স্থানীয়্ভাবে নিন্মচাপের সৃষ্টি হয়। এর ফলে
পার্শ্ববর্তী বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্পপূর্ন বায়ুর আগমন ঘটে এবং ঐ বাতাস আরও উষ্ণ
হয়ে উর্ধাকাশে গিয়ে বর্জ্রমেঘের(Cumulonimbus)সৃষ্টি করে।কখনো কখনো এই মেঘ সঞ্চারণের কারনে ঝড়-বৃষ্টির
সাথে শিলাবৃষ্টিও হয়।স্থানীয়্ভাবে সংগঠিত এই ঝড়-বৃষ্টি কালবৈশাখী(Nor’wester)নামে পরিচিত।কালবৈশাখীর পর বাতাসের গড় তাপমাএা ৬°-৯° সেলসিয়াস পর্যন্ত
কমে যায় ও গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে মুক্তি মেলে। বৈশাখে পর্যাপ্ত কালবৈশাখী হ’লে সাধারণত জ্যৈষ্ঠ মাস রৌদ্রোজ্বল ও মেঘমুক্ত
থাকে, যা নিন্মচাপ সংঘটনের মাধ্যমে আষাঢ়ের প্রারম্ভে মৌসুমী বর্ষার আগমনকে নিশ্চিত
করে ও উত্তম বর্ষার পূর্বাভাস দেয়।
চিত্র: কালবৈশাখী - লেখক |
২.আষাঢ়ের প্রারম্ভে নীচু
মেঘের উত্তারাগমন – মৌসুমী বর্ষা
ঋতুর আগমন বার্তা
আষাঢ় মাস হ’ল দক্ষিন-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর আগমন পর্ব। এই সময় মৌসুমী বায়ুর
সক্রিয়তা সর্বাধিক হয়। ফলে জলীয়বাস্পপূর্ণ দক্ষিনা বাতাসের প্রাবল্য বৃদ্ধি পায় ও
গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে নীচু মেঘ (Stratocumulus) উত্তর দিকে (বঙ্গোপসাগর থেকে স্থলভাগের
অভ্যন্তরে) গমন করে যা আসন্ন বর্ষা ঋতুকে নির্দেশ করে।
চিত্র: নীচু মেঘের উত্তারাগমন - লেখক |
৩. শীতল-আর্দ্র বাতাসের আগমন – বৃষ্টির পূর্বাভাস
গ্রীষ্মকালে কোন স্থানে হঠাৎ শীতল-আর্দ্র বাতাসের আগমন হ’লে বুঝতে হ’বে
পার্শ্ববর্তী কোন অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই শীতল-আর্দ্র বাতাস অনেক সময় আগত
স্থানে বাতাসের তাপমাএা ৪°-৬° সেলসিয়াস কমিয়ে
দেয় ও তাকে সম্পৃক্ত (Saturation)
হতে সাহায্য করে।ফলত ঐ স্থানেও বৃষ্টিপাতের সমূহ সম্ভাবনা
দেখা যায়।
৪.বর্ষাকালে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দীর্ঘকালীন বায়ুপ্রবাহ
– দীর্ঘস্হায়ী প্রবল বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস
বায়ুচাপের পরিবর্তনের প্রকৃতি(Barometric
Tendency) লক্ষ্য করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। বর্ষাকালে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের
কোনস্থানে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে যদি একটানা বায়ু প্রবা্হিত হয়, তাহলে বুঝতে হ’বে দক্ষিন বা দক্ষিন-পশ্চিম দিকে
অর্থ্যৎ বঙ্গোপসাগরে নিন্মচাপের সৃষ্টি হয়েছে এবং তা স্থলভাগের দিকে ক্রমশ অগ্রসর
হচ্ছে। এই নিন্মচাপ স্থলভাগে প্রবেশ করার পর কোন স্থানে স্থায়ী হ’লে দীর্ঘস্হায়ী
প্রবল বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
৫. বর্ষাকালে মেঘলা আকাশ ও কম বর্জ্রপাত – দীর্ঘস্থায়ী
হাল্কা বা মাঝারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস
বর্ষাকালে আকাশ যদি থাকে মেঘলা এবং বর্জ্রপাত
সংঘটিত না হয়, তাহলে দীর্ঘস্থায়ী হাল্কা বা মাঝারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা
থাকে। এ ধরনের বৃষ্টিপাত কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত উপকারি। সাধারণত নীচু মেঘের (Nimbostratus) একত্রিভবনের ফলে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি
হয়। কারণ এ ধরনের মেঘের অনুভূমিক বিস্তার
বেশী ও উল্লম্ব বিস্তার কম হয়।ফলে বায়ুপুঞ্জের মধ্যে উত্তাপের পার্থক্য
এবং তাপগতিজনিত অস্থিতিশীলতা (Thermodynamic Instability) কম থাকে। ফলে বর্জ্রপাত হয় না এবং মেঘ ঐ স্থানে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে হাল্কা থেকে মাঝারি বর্ষণ করে।
চিত্র: Nimbostratus মেঘ ও দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টিপাত - লেখক |
৬. আশ্বিনে
মেঘের দক্ষিনে প্রবাহ – ঘূর্ণী্ঝড় ও প্রবল বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস
আশ্বিন মাস
হ’ল দক্ষিণ – পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রর্ত্যাবর্তন কাল ও উত্তর পূর্ব মৌসুমি বায়ুর
সূচনা পর্ব। এই দুই বিপরীতধর্মী বায়ুর
সংঘাতে উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রায়শই ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয় ও ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রের
দিকে বায়ু প্রবাহিত হয়।ফলে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে মেঘ দক্ষিনে প্রবাহিত হতে দেখা যায়। এই ঘূর্ণবাত জনিত প্রবল ঝড় ও বৃষ্টিপাত ‘আশ্বিনের ঝড়’
নামে পরিচিত। আশ্বিনের ঝড়ের ফলে শারদ উৎসবের প্রস্তুতি যেমন ব্যাহত হয় তেমনি
শষ্যহানিও হয়।
৭. আকাশে মাছের আঁশের মত মেঘ ও সূর্য্য বা চন্দ্রবলয় - ঘূর্ণী্ঝড়ের পূর্বাভাস
প্রাক বর্ষা মরসুমে বা বর্ষাকালের অন্তিমলগ্নে
(আশ্বিন)দীর্ঘ কয়েকদিন মেঘমুক্ত আকাশের পর অনেক সময় সূর্য্য বা চন্দ্রবলয় দেখা যায়। এর অব্যবহিত পর অকাশে মাছের আঁশের মত মেঘও দেখা যায়। এই ঘটনাক্রম ঘূর্ণীঝড়ের পূর্বাভাস
দেয়। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে নিন্মচাপের কারনে Cirrus
ও Cirrostratus
(উর্ধস্তরীয়)মেঘের আগমন ঘটে। এই মেঘদ্বয়ের মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্বচ্ছ বরফের
স্ফটিক থাকায় সূর্য্যের বা চাঁদের আলো বিচ্ছুরিত হয় এবং বলয়ের (Halo) সৃষ্টি হয়।পরবর্তীতে এরা Altocumulus ও
Altostratus মেঘে পরিনত হ’য় যা ঘূর্ণী্ঝড় মেঘ (Cyclone
Cloud) নামে পরিচিত।এই দুই মেঘ মধ্যাকাশের
মেঘ, মূলত উষ্ণতাজনিত প্রবল নিন্মচাপের কারনে সৃষ্টি হয়।
চিত্র: সূর্য্য বলয়- লেখক |
গাছপালা
ও পশুপাখির আচরনগত নিরীক্ষণ (Behaviour of plants and animals):
১.ফুলে পূর্ণ
নিমগাছ - মৌসুমী বর্ষা ঋতুর আগমন
বার্তা
বাতাসের তাপমাত্রা ৩৫°-৩৮° সেলসিয়াস হ’লে (বৈশাখ
বা জ্যৈষ্ঠ মাসে)নিমগাছে
ফুল আসে।এই তাপমাত্রা নিন্মচাপ সৃষ্টির উপযোগী এবং মৌসুমী বিস্ফোরণের (Burst of Monsoon)
মাধ্যমে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে মৌসুমী বর্ষার আগমনকে নিশ্চিত করে। হিমালয়
সংলগ্ন অঞ্চলে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের শুরু হয় শৈল্যৎক্ষেপ (Orographic) বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে। কিন্ত গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে
পাহাড়-পর্বতের অনুপস্থিতির কারনে শৈল্যৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত সম্ভব নয়। তাই এখানে মূলত নিন্মচাপের মাধ্যমে মৌসুমী বায়ুর আগমন ঘটে। মৌসুমী ঋতুর আগমনকালে বাতাসের তাপমাত্রা ৩৫° সেলসিয়াস অতিক্রম
করলে স্থানীয়ভাবে প্রবল নিন্মচাপ সৃষ্টি হয় যা মৌসুমী
বায়ুকে টেনে আনে ফলে বর্জ্রমেঘের(Cumulonimbus)সঞ্চারণের মাধ্যমে প্রবল বৃষ্টিপাতের প্রারম্ভ হয়। একেই বলে মৌসুমী বিস্ফোরণ বা Burst of Monsoon। এই বৃষ্টিপাতের
ফলে বাতাসের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে প্রায় ৬° সেলসিয়াস কমে
যায়, যার ফলে জলীয়বাষ্পের ঘণীভবনের অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ও মৌসুমী বৃষ্টিপাতকে স্থায়ীত্ব
দেয়।
চিত্র: ফুলে পূর্ণ নিমগাছ - লেখক |
২. পর পর দু বছর আমের
ভালো ফলন – মৌসুমী ঋতুতে অধিক বৃষ্টির পূর্বাভাস
সাধারণত: পর পর দু বছর আমের ভালো ফলন কম
লক্ষ্য করা যায়, আর যদি তা ঘটে তাহলে জানতে হবে সে বছর বর্ষাকালে স্বাভাবিকের থাকে
অধিক বৃষ্টি হবে। বর্ষাকাল ও তার পরবর্তী সময়ে বৃষ্টি কম হলে, সে বছর আম গাছে ফুল
বা মঞ্জরী অধিক আসে। কারন দীর্ঘ শুষ্কাবস্থার পর গুঁড়িযুক্ত গাছের দেহে জলাভাব ঘটে,
যার ফলে কলা ও কোষে কার্বোহাইড্রেট সঞ্চায়ন অধিক হয়। যা উদ্ভিদের বর্ধনশীল (Vegetative) পর্যায়
থেকে প্রজনন (Reproductive) পর্যায়ে উত্তরণ হারকে ত্বরান্বিত করে ও ফুল বা মঞ্জরীর পরিমাণকে বাড়িয়ে দেয়।
এই ঘটনা কে বলা হয় Water
stress induced flowering বা জলের নিষ্পেন জনিত পুস্পোদগম। অর্থাৎ,
যে বছর খরা বা স্বাভাবিকের থেকে কম বৃষ্টি হয় সে বছর আমের ফলন ভালো হয়। আবার পর পর
দু বছর স্বল্প বৃষ্টিপাতের পর সাধারণত: অধিক বৃষ্টিপাত প্রত্যক্ষ করা যায়। তাই পর
দু বছর আমের ফলন ভালো হলে আগামী মৌসুমীবর্ষা
ঋতুতে অধিক বৃষ্টি ও বন্যার আশঙ্কা করা হয়।
চিত্র: আমের ভালো ফলন - লেখক |
৩. ফড়িং
এর আনাগোনা – আসন্ন ঝড় ও বৃষ্টির পূর্বাভাস
প্রবল
ঝড়-বৃষ্টির সময় ফড়িংদের উড়তে দেখা যায় না। এদের
শরীর অপেক্ষা ডানা বেশ বড় তাই প্রবল বায়ু
প্রবহের সময় সহজেই শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়। তাই এরা ঝড়ের পূর্বে সতর্ক হয়। আবার তাপমাত্রা তারতম্যে ফড়িংদের আচরনগত
পার্থক্যও লক্ষ্য করা যায়। শরীর অপেক্ষা ডানা বড় হবার কারণে এদের ওড়ার জন্য অধিক শক্তি লাগে। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে
শরীর ঠান্ডা ও ভারী হয়ে যায় এবং ওড়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির অভাব ঘটে। কোনস্থানে বৃষ্টির ঘন্টা দুয়েক
আগে বায়ু সম্পৃক্ত (Saturation) হওয়ার কাছাকাছি চলে আসে। এই সম্পৃক্ত বায়ু ফড়িংদের মধ্যে আকষ্মিক শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন আনে ও তারা ঝড়-বৃষ্টির আভাস পায়।
বৃষ্টির পর বায়ুর তাপমাত্রা হ্রাস জনিত কারণে ফড়িংদের শরীরেও শক্তির ঘাটতি হয়। তাই
বৃষ্টির পূর্বে শরীরকে গরম রাখার জন্য
তারা দল বেঁধে দ্রুত গতিতে উড়তে থাকে। কিন্ত বৃ্ষ্টি শুরু হলেই এরা অদৃশ্য হয়, ফড়িংদের
এই আচরণকে বলা হয় pond abandonment behaviour । তাই কোন স্থানে হঠাৎ ফড়িংদের দলবদ্ধ আনাগোনা ও
অস্থিরতা বৃষ্টির পূর্বাভাস
দেয়।
চিত্র:ফড়িং এর আনাগোনা - thedragonfywomen.com |
৪. ছাগল, ভেঁড়ার অস্থিরতা ও অনবরত ডেকে চলা - বৃষ্টির পূর্বাভাস
বর্ষাকালে
নীচু মেঘ (Nimbostratus) সৃষ্টির সময় বাতাসে লীনতাপ মুক্ত হয় এবং আর্দ্রতার পরিমান অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতে বায়ু প্রায় সম্পৃক্ত (Saturation) হয়ে ওঠে ।ফলে শরীর থেকে প্রচুর ঘাম নিঃসরিত হতে
থাকে। কোন স্থানের বায়ু সম্পূর্ণ সমপৃক্ত
(Saturation) ও স্থিতিশীল হলে সা্ধারণত বৃষ্টিপাত
হয়। ছাগল ও
ভেঁড়ার শরীর লোমশ থাকার কারনে তাদের শরীর ঘামে পরিপূর্ণ হয় ও প্রবল অস্বস্তি হয়। ঘাম
কানের পাতায় জমতে থাকলে তারা কান ঝাপটাতে
থাকে, লাফালা্ফি করে এবং অনবরত ডেকে চলে।
এই পরিস্থিতি বৃষ্টির পূর্বাভাস দেয়।
চিত্র: বৃষ্টির পূর্বে ছাগলের অস্থিরতা - লেখক |
৫. উঁই ও কালো পিঁপড়ের স্থানত্যাগ – বর্ষার আগমনের পূর্বাভাস
বর্ষার আগমনে বায়ুর আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায় ও তা ক্রমশ সম্পৃক্ত হতে
থাকে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এই পতঙ্গদের শরীরের
রোমগুলি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে তারা বর্ষার আগমন বার্তা পায় ও দল বেঁধে, ডিম নিয়ে
অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত স্থানের উদ্দেশ্যে গমন করে। তাই মৌসুমী বর্ষা ঋতুর প্রারম্ভে
হাজার হাজার উঁই ও পিঁপড়ের আনাগোনা দেখা
যায়।
চিত্র: কালো পিঁপড়ের স্থানত্যাগ - Kilgore Forelle |
৬. মাটির
মধ্যে মুরগীর পালক ঢোকানো – আর্দ্রতা বৃদ্ধির পূর্বাভাস
উত্তাপের পরিসর বৃদ্ধি পেলে মৃত্তিকা থেকে বাস্পীয়ভবনের পরিমাণও বৃদ্ধি
পায়। তবে বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা সর্বাধিক স্তরে পৌঁছালে, মৃত্তিকা থেকে বাস্পীয়ভবনের হার হ্রাস পায় ও মৃত্তিকার উপপৃষ্ঠীয় (sub-surface) স্তরে আর্দ্রতা আবদ্ধ হয়। উক্ত
পরিস্থিতিতে উপপৃষ্ঠীয় স্তরের তাপমাত্রা
বাতাসের থেকে কম থাকে। মুরগীরা মৃত্তিকা ও বাতাসে আর্দ্রতার পরিবর্তনকে বু্ঝতে পারে।
তাই মাটির মধ্যে পালক ঢুকিয়ে নিজেকে সিক্ত
করে গরমের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করে।
চিত্র: মাটির মধ্যে মুরগীর পালক ঢোকানো - লেখক |
শারীরিক অনুভূতিগত নিরীক্ষণ (Physiological Indicators):
১. ভ্যাপসা গরম ও
মাত্রারিক্ত ঘাম – বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস
মানব শরীরও আবহাওয়ার পরিবর্তনকে বুঝতে পারে। যেমন
বৃষ্টির পূর্ব মূহুর্তে আপেক্ষিক আর্দ্রতা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছালে ভ্যাপসা (Muggy) পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় ও শরীর
থেকে অত্যাধিক ঘামের নিঃসরণ হয়। কারন বাতাসে
জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে শরীর থেকে নির্গত ঘাম সহজে বাস্পীভূত
হতে পারেনা ও শরীর দীর্ঘ সময় ধরে ঘর্মাক্ত থাকে। যা সম্পৃক্ত বাতাসের ইঙ্গিত বহন করে ও অনতিবিলম্বে বৃষ্টির
পূর্বাভাস দেয়।
২. গ্রীষ্মকালে ত্বক
রুক্ষ-শুষ্ক – বৃষ্টিহীন শুষ্ক আবহাওয়ার ইঙ্গিত
গ্রীষ্মকালে
যদি ত্বক রুক্ষ-শুষ্ক হয়ে যায় বা ঠোঁট এবং নাকের প্রান্তভাগ ফেটে যায় (গাঙ্গেয়
পশ্চিমবঙ্গে ব্যতিক্রমি ঘটনা) তা দীর্ঘকালীন বৃষ্টিহীন আবহাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। বাতাসে জলীয়বাষ্প কম থাকলে শরীর থেকে এত দ্রুত
বাষ্পীভবন ঘটে যে তা ঘাম হিসাবে শরীরে জমার সুযোগ পায় না (ঠিক যেমন শীতকালে হয়) এবং আর্দ্রতার অভাবে
ত্বকের নরম অংশ ফেটে যায়। প্রাক-মৌসুমি ঋতুতে ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে শুষ্ক গরম
বাতাস গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করলে এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। যার ফলে বাতাসের তাপমাত্রা
স্বাভাবিকের থেকে প্রায় ৫° থেকে ৭° সেলসিয়াস বেড়ে যায়, যাকে তাপপ্রবাহ বলে। বায়ুমন্ডলে আর্দ্রতার এই সাময়িক
ঘাটতি মৌসুমি বর্ষার আগমনকে বিলম্বিত করে।
৩.দীর্ঘসময় সিক্ত কেশ – বৃষ্টিপাতের স্থায়ীত্বের পূর্বাভাস
বর্ষাকালে
যদি কয়েকদিন স্নানের পর দীর্ঘসময় কেশ সিক্ত থাকে তাহলে জানতে হবে বৃ্ষ্টিপাত বেশ কয়েকদিন
স্থায়ী হবে। বাতাসে আর্দ্রতা অধিক থাকলে ভেজা চুল শুষ্ক হতে অনেক সময় নেয়। বাতাসের
আর্দ্রতা অধিক হলে তা দ্রুত সম্পৃক্ত হয়ে বৃষ্টিপাতকে যেমন ত্বরান্বিত করে তেমনী স্থায়ী
করে।
চিত্র: দীর্ঘসময় সিক্ত কেশ - You Tube |
উপরিউক্ত
আলোচনা থেকে বলা যায় প্রাকৃতিক জগতের পরিবর্তন, পশুপাখিদের আচরণগত পার্থক্য ও মানব
শরীরের উপলবদ্ধি দ্বারা স্থানীয়ভাবে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের প্রকৃতি ও পরিমাণগত পূর্বাভাস
দেওয়া সম্ভব। তবে এই পদ্ধতিগুলি স্বল্প পরিসর ও মেয়াদে যতটা
কার্যকরি, দীর্ঘ মেয়াদে ও পরিসরে ততটা নয়। অপরপক্ষে আবহওয়া দপ্তর এবং মৌসম ভবন
যে পূর্বাভাস দেয় তা বৃ্হৎ পরিসর ও দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকরি হলেও, স্থানীয় স্তরে
তার বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং
এই দুই পদ্ধতির বিজ্ঞানসম্মত সমন্বয় সাধন প্রয়োজন যা গ্রামীন জনগণের জীবন ও জীবিকাকে
উন্নততর করবে। আগামীতে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা হবে বলে আশা করা
যায়।